জলবায়ু-উদ্বাস্তু বস্তিবাসীদের জন্য তহবিল ও নগর পরিকল্পনা চাই : পবা

জলবায়ু-উদ্বাস্তু বস্তিবাসীদের জন্য তহবিল ও নগর পরিকল্পনা চাই : পবা

 

ঢাকা ১৭ নভেম্বর ২০২১ :

‘আমরা ঝুপড়িতে থাকি, বৃষ্টির দিনে পানি পড়ে আর গরমে ফোস্কা পইড়া যায়।

ময়লা আবর্জনার ভিতরে কোনোমতে আমরা বাঁচি। একটা পায়খানা নাই আমরার বস্তিতে।

মেয়েরা পায়খানায় গেলে পাহারা দিতে হয়। আমরা যা কামাই করি সব খরচ হয় ঘরভাড়া আর ঔষধ কিনতে।

দশ হাত ঝুপড়ি ঘরেই থাকা, খাওয়া, রান্না সবই করতে হয়। আমরা তো শখ কইরা শহরের বস্তিতে আসি নাই। আমরা নদীভাঙ্গা মানুষ। ঘূর্ণিঝড় আর বন্যা দিনে দিনে বাড়তেছে আর গ্রাম থেকে আমরার মতো গরিব মানুষ শহরের বস্তিতে আসতেছে।

কিন্তু বস্তিতে আইস্যাও কষ্টের দিন শেষ হইতেছে না। আমরা এই কষ্ট থেইক্যা বাঁচতে চাই।’

জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে ১৭ নভেম্বর ২০২১ বেসরকারী উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক, পবা এবং কাপ আয়োজিত ‘জলবায়ু সংকটে নগর দরিদ্রদের জীবনমান উন্নয়নে করণীয়’ শীর্ষক সংলাপে এই বক্তব্য তুলে ধরেছেন মোহাম্মদপুর ঝিলপাড় বস্তির শেফালী আক্তার।

শেফালী আক্তারের পাশাপাশি বস্তিবাসী অধিকারকর্মী হোসনে আরা বেগম রাফেজা, প্রাণকমল সরকার, তানিয়া বেগমও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে স্থানচ্যুত হয়ে নগরে আসা বস্তিবাসী নগরদরিদ্রদের নানা সংকট ও সমাধানের কথা তুলে ধরেন সংলাপে।

পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে এবং বারসিকের ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বলের সঞ্চালনায় সংলাপে সম্মানিত অতিথি হিসেবে আলোচনা করেন বিশিষ্ট স্থপতি শাসসুল ওয়ারেস, কোয়ালিশন ফর দ্য আরবান পুওর (কাপ) এর সহ সভাপতি মো: মাহবুবুল হক, বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান স্থপতি মোসলেহ উদ্দিন, কাপের নির্বাহী পরিচালক খন্দকার রেবেকা সান ইয়াত, বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ, নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম (নাসফ) এর সাধারণ সম্পাদক মো: তৈয়ব আলী, বাংলাদেশ গ্রীণ রুফ মুভমেন্টের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: গোলাম হায়দার প্রমূখ।

স্থপতি শামসুল ওয়ারেশ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ গৃহহারা আজকের শহরের নগরদরিদ্রদেও জন্য বাসযোগ্য নগর ও নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য আমাদেও মানবিক পরিকল্পনা ও দক্ষ নেতৃত্ব দরকার। যেমন, বঙ্গবন্ধুর দক্ষ নেতৃত্বে গড়ে ওঠেছে এই দেশ।

আমাদের সংবিধান সব মানুষকে সমান অধিকার দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আজ কেউ সব হারিয়ে শহরে এসে আরো ঝুঁকিতে পড়বে তা হবে না। তারা তো আর ইচ্ছে করে শহওে আসে না। এই মানুষেরা যখন গ্রামে ছিল তখন তারা ছিল সম্পূর্ণ মানুষ।

সেখানে তাদেও সমাজ ছিল, সেখানে তাদের শেকড় প্রোথিত ছিল। এই মানুষদের যখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শহরে আসে তখন সে সব হারায়, প্রাণ হারায়। মানুষ কষ্ট সহ্য করতে পারে, কিন্তু কোনো অন্যায় সহ্য করতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের নামে আজ মানুষের সাথে অন্যায় করা হচ্ছে। এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। এই শেকড় হারানো উদ্বাস্তু গরিব মানুষের জন্য সঠিক তহবিল ও নগর পরিকল্পনাও জরুরি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী আবদুস সোবহান বলেন, ধনী দেশকে অবশ্যই সবার কার্বণ নির্গমণ বন্ধ করতে হবে, কারণ আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী নই কিন্তু এরজন্য আমরা প্রতিদিন সমস্যায় পড়ছি, নগরেও চাপ বাড়তেছে।

আজ নগর বস্তিবাসীদের বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি করতে হলে, সঠিক অভিযোজন কর্মসূচি তৈরি করতে হলে তহবিল দরকার, আর এরজন্য সরকারকে আরো বেশি আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আজ গ্রামীণ জনগোষ্ঠী যেভাবে স্থানচ্যুত হয়ে নগরে আসছে এবং এর ফলে নগরে যেভাবে নানাবিধ সংকট তৈরি হচ্ছে অবশ্যই এক সঠিক পরিকল্পনার ভেতর দিয়ে এই চাপ, নতুন সংকট ও সমস্যা উত্তরণে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।

আজ নগর ও উন্নয়ন পরিকল্পনাকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্থানচ্যুত হয়ে নগরে আসা দরিদ্র মানুষদের তালিকা তৈরি করা জরুরি। তাদের সামগ্রিক ক্ষয়-ক্ষতির হিসাব নিরূপণ করা জরুরি।

জাতীয় ক্ষয়-ক্ষতির প্রতিবেদনে এই তথ্য ও পরিসংখ্যান উপযুক্তভাবে নথিবদ্ধ হওয়া জরুরি। আন্তর্জাতিক মানদন্ডে এই ক্ষয়-ক্ষতির তালিকায় একইসাথে ইকোনমিক এবং নন-ইকোনমিক ক্ষয়-ক্ষতিকে সুনির্দিষ্ঠভাবে উল্লেখ করতে হবে। নগরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অভিযোজন, আবাসন এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এই ক্ষয়-ক্ষতির হিসাবকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।

ভূগোলবিদ ও নগরগবেষক জাহাঙ্গীর আলম ধারণাপত্রে বলেন, নগর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সচেতনতা ও দক্ষতা বাড়ানো এবং সকল ধরণের সরকারি সেবা-সহযোগিতায় তার অভিগম্যতা নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে নগরদরিদ্রদের আবাসন, বর্জ্যব্যবস্থাপনা, কৃটিরশিল্পভিত্তিক নিরাপদ কর্মসংস্থান, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণসহ উপযোগী অভিযোজন উদ্যোগ গুলোকে সহায়তা করু জরুরি। আর এই কাজে স্থানীয় সরকার, প্রশাসন, গণমাধ্যম, সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, বস্তিবাসীদের নিয়ে কর্মরত সংগঠন সকলের ঐক্য জরুরি।

সংলাপে সুনির্দিষ্ট ৯ দফা দাবি পেশ করে বক্তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন কপ-২৬ সবেমাত্র শেষ হলো গ্লাসগোতে। ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ) এবং ভি-২০ এর চেয়ার হিসেবে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘অ্যা বাংলাদেশ ভিশন ফর গ্লোবাল ক্লাইমেট প্রসপারিটি’ শীর্ষক গুরুত্বপূর্ণ দাবি ও প্রস্তাব তুলে ধরেছেন গ্লাসগোতে।

এনডিসি, জলবায়ু তহবিল, অভিযোজন, জলবায়ু-উদ্বাস্তু এবং কার্বন নির্গমণ হ্রাস বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও বিশ্লেষণ গুরুত্ববহ। । জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আজ স্থানচ্যুত নগরের দরিদ্র মানুষের অভিযোজনের জন্য এবং এক বাসযোগ্য নগর গড়ে তেলার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আহবানে সাড়া দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আমাদেও সবাইকে একসাথে কাজ করা জরুরি।

বাংলাদেশ আওয়ামী বাস্তুহারা কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারন সম্পাদক কবি রাশেদ হালদার বাংলাদেশের ৬৬,১৮৯ গৃহহীন পরিবারকে আশ্রয়ণের বিশ^রেকর্ড গড়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ ও গৃহহীন সকল মানুষের জন্য দ্রুত আবাসন ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার আহবান জানান।

পবার চেয়ারম্যান বিশিষ্ট পরিবেশবাদী সংগঠক আবু নাসের খান বলেন, ঢাকাসহ দেশের সকল নগর দরিদদ্রের মৌলিক নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নগর দরিদ্রদের এলাকায় পরিকল্পিত বর্জ্যব্যবস্থা, বর্জ্য থেকে সম্পদ রূপান্তরের কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

পরিকল্পিত নগরকৃষির আওতায় নগর বস্তি ও নগর দরিদ্রদের যুক্ত করতে হবে। নগরবস্তি এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী নিরাপদ বিষমুক্তক খাদ্য উৎপাদনে ভ’মিকা রাখতে পারে আর এজন্য দরকার বহুমুখী সহযোগিতা ও পরিকল্পনা। নগরের নি¤œ আয়ের মানুষদের জন্য বিনামূল্যে নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। চিকিৎসা সেবা দরিদ্র বান্ধব এবং সহজলভ্য করতে হবে।

নগরের নি¤œ আয়ের মানুষদের জন্য পানি, বিদ্যুৎ, জ¦ালানী, পয়ঃনিস্কাশন এবং বজ্র ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবেলায় নগর দরিদ্রদের জন্য বিশেষ ঝুকি ভাতা , প্রনোদনা, প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ঢাকা শহরের খাল, প্রাকৃতিক জলাশয়, উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ, পার্ক, বিনোদন স্থল, শরীর চর্চা স্থল নগরের সকল শ্রেনী পেশার মানুষের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

সকলের সচেতনতা বাড়িয়ে দায়িত্বশীল নাগরিক আচরণের মাধ্যমে সবাইকে নিয়ে সকলের জন্য বাসযোগ্য নগর গড়ে তোলার আহবান জানিয়ে সংলাপ অনুষ্ঠান শেষ হয়।

সর্বশেষ