এবার গাজীর অবৈধ সম্পদে দুদকের হানা
সাবেক বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং বিদেশে পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল রবিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে এই অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দুদক সূত্র কালের কণ্ঠকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।

ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে গোলাম দস্তগীর গাজী নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়েছেন। অর্জিত এই সম্পদ তিনি হুন্ডি এবং আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছেন। এ ছাড়া রূপগঞ্জকে কুক্ষিগত করে গড়েছেন গাজীগঞ্জ। অবৈধভাবে জমি দখল, নদী দখল, বালু উত্তোলন, মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজির অর্থে তিনি এই অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। দুদকের আমলে নেওয়া অভিযোগ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। টানা চতুর্থবার আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ-১ আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হয়েছিলেন গোলাম দস্তগীর গাজী। তিনি শিল্পগোষ্ঠী গাজী গ্রুপের চেয়ারম্যান। গতকাল ভোররাতে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

বিদেশে হাজার কোটি টাকা পাচার

অভিযোগে বলা হয়, অঢেল সম্পদের মালিক বনে যাওয়া গোলাম দস্তগীর গাজী যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ে অর্থ পাচার করেছেন।হুন্ডি ছাড়াও আমদানি ও রপ্তানির আড়ালে তিনি ওই অর্থ পাচার করেন। পাচার করা অর্থে বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও গড়েছেন তিনি। মালয়েশিয়ায় মাই সেকেন্ড হোম প্রকল্পের আওতায় তিনি সেখানে অর্থ পাচার করেছেন। সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ে তাঁর বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।

গাজীর দেড় হাজার কোটি টাকার সম্পদ

অভিযোগে বলা হয়, গত ১৫ বছরে গোলাম দস্তগীর গাজীর সম্পদ ও ঋণ দুটিই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি মিলিয়ে বর্তমানে তিনি প্রায় এক হাজার ৪৪৬ কোটি টাকার মালিক। এই সম্পদের বিপরীতে তাঁর ব্যাংকঋণ ৯৩৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে দেনা এক হাজার ২২ কোটি টাকা।

অন্যদিকে গত ১৫ বছরে গোলাম দস্তগীরের স্ত্রী রূপগঞ্জের তারাব পৌরসভার সাবেক মেয়র হাসিনা গাজীর অস্থাবর সম্পদ দুই কোটি ১৯ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ছয় কোটি ৯০ লাখ টাকা হয়েছে। তিন কোটি ৮৭ লাখ টাকার স্থাবর সম্পত্তি বেড়ে হয়েছে চার কোটি ৬২ লাখ টাকা। হাসিনা গাজীর কাছে থাকা স্বর্ণালংকারের দাম দেখানো হয়েছে ২৪ হাজার টাকা। গত ১৫ বছরে পাটমন্ত্রীর সম্পদ বেড়েছে ২৫ গুণ। সম্পদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ১৫ বছরে ব্যাংকঋণ বেড়েছে ২১ গুণ।

১৫ বছর আগের হলফনামা অনুযায়ী স্নাতক পর্যন্ত পড়াশোনা করা গোলাম দস্তগীর গাজী পেশায় ভবনের ভাড়া, ব্যবসা, বোনাস শেয়ার, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের লভ্যাংশ ও বোর্ড মিটিং বাবদ বছরে সাত কোটি ৬৭ লাখ ৩৮ হাজার টাকা আয় করতেন। এখন তিনি ভবনের ভাড়া, ব্যবসা, বিনিয়োগের লভ্যাংশ ও সংসদ সদস্য ভাতা বাবদ বছরে ৮৩ কোটি ২৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা আয় করেন। এ হিসাবে ১৫ বছরে তাঁর বার্ষিক আয় বেড়েছে প্রায় ১১ গুণ।

১৫ বছর আগে গোলাম দস্তগীরের নগদ ৯৪ লাখ ১২ হাজার টাকা, ১৬ লাখ সাত হাজার টাকা ব্যাংক জমা, সাড়ে চার কোটি টাকার কম্পানি শেয়ার, ৩৯ লাখ ৮০ হাজার টাকার যানবাহনসহ মোট ৪৫ কোটি ৯৭ লাখ ৬০ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ ছিল। স্থাবর সম্পদ ছিল ১১ কোটি ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকার। স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে মোট ৫৭ কোটি সাত লাখ ২০ হাজার টাকার সম্পদ ছিল। ১৫ বছর পর নগদ ৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা, ৬১ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে জমা, ২২ কোটি পাঁচ লাখ টাকার শেয়ার, এক কোটি ৯৩ লাখ টাকার যানবাহনসহ অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৩৩৮ কোটি ৮৬ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা।

অকৃষি জমি ও ভবন বাবদ স্থাবর সম্পদ আছে ১০৭ কোটি ৩১ লাখ টাকার। বর্তমানে স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে মোট এক হাজার ৪৪৬ কোটি টাকার সম্পদ আছে গোলাম দস্তগীরের, ২০০৮ সালের তুলনায় যা ২৫ গুণ বেশি। সম্পদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঋণও বেড়েছে। ২০০৮ সালে তাঁর ব্যাংকঋণ ছিল ৪৩ কোটি ৩৫ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। বর্তমানে তাঁর ব্যাংকঋণ ৯৩৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এই হিসাবে সাবেক পাটমন্ত্রীর ঋণ বেড়েছে ২১ গুণ।

গাজীর কুক্ষিগত রূপগঞ্জ

অভিযোগে বলা হয়, রাজধানী ঢাকার পাশেই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, এখানকার প্রতিটি গ্রাম ছিল সবুজ-শ্যামল। এর পরিবেশ-প্রকৃতি মুগ্ধ করত সাধারণ মানুষকে। গোলার ধান, জমির সবজি, পুকুরের মাছ, বাড়ির হাঁস-মুরগিতে স্বাবলম্বী ছিল এই গ্রামীণ জনপদ। কিন্তু মাত্র ১৫ বছরে পুরো এলাকা ধূসর মরুভূমিতে রূপ নিয়েছে। জবরদখলে হারিয়েছে প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্য। এসবের হোতা গোলাম দস্তগীর গাজী। তিনি পুরো রূপগঞ্জকে কুক্ষিগত করে রেখেছেন।

এ জন্য অস্ত্রবাজ, সন্ত্রাসীদের লালন-পালন থেকে শুরু করে সবই করছেন তিনি। এলাকায় মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাস, খুন-গুম, জবরদখল—সব কিছুই তাঁর বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। সরকারি-বেসরকারি সব স্থাপনায় তিনি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নাম যুক্ত করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের আবাদি জমিতে গাজী স্টেডিয়ামের সাইনবোর্ড বসিয়ে বালু ভরাট করে বিভিন্ন কম্পানির কাছে বিক্রি করা হয়েছে।

কোথাও আবাদি জমি ও বসতভিটা দখল করে গাজী গ্রুপের বিভিন্ন কারখানা নির্মাণ করা হয়েছে। করছেন আবাসন প্রকল্পও। তাঁর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এলাকা ছাড়তে হয়েছে অনেক সংখ্যালঘু পরিবারকে। আর এসব অপকর্মের মাধ্যমে তিনি গত ১৫ বছরে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

জমি দখল করে গাজীপার্ক ও কারখানা

অভিযোগে বলা হয়, রূপগঞ্জের কেয়ারিয়া, পর্শি, বাড়িয়াছনি, কুমারপাড়া এলাকায় কয়েক শ হিন্দু পরিবারের বসবাস। সেখানকার ৮০ শতাংশ হিন্দুর জমি জিপার্ক (গাজীপার্ক) নামে সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরাও করে বালু ভরাট করেছেন গোলাম দস্তগীর গাজী। জবরদখল, নামমাত্র মূল্যে জমি বিক্রিতে বাধ্য করে হিন্দুদের এসব জমি নেওয়া হয়েছে।

নামমাত্র মূল্যে এক থেকে দেড় শ বিঘা জমি কিনে প্রায় ৬০০ বিঘা জমি দখল করা হয়েছে। এ ছাড়া রূপগঞ্জের খাদুন এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে গাজী টায়ার ফ্যাক্টরি। এই ফ্যাক্টরির প্রায় ৮০ শতাংশ জমিই জোর করে দখল করা হয়েছে। আয়েত আলী ভুঁইয়ার ছেলে হাজী আমজাদ আলী ভুঁইয়ার ১৯ বিঘা ৮ শতাংশ, হাজী আব্দুল হাইয়ের চার বিঘা, মোবারক হোসেনের দেড় বিঘা, আব্দুল বারী ভুঁইয়ার দুই বিঘা, নূর মোহাম্মদের এক বিঘা, ইসমাইল খাঁর চার বিঘা, সিরাজ খাঁর চার-পাঁচ বিঘা, শাহ আলমের প্রায় ৭০ শতাংশ, জুলহাস ভুঁইয়ার ৭১ শতাংশ এবং আপেল মাহমুদের আড়াই বিঘা জমি জোরপূর্বক দখল করে খাদুনে গাজী টায়ার ফ্যাক্টরি তৈরি করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের পদ ও মন্ত্রিত্বের প্রভাব খাটিয়ে উপজেলার বিরাব, কাঞ্চন, ভালুকাব, টেংরারটেক, পোনাব, আমলাব, কেশরাব, আধুরিয়া, পূর্বগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার প্রায় দেড় হাজার বিঘা হিন্দু-মুসলিমের মালিকানা জমি ও খাসজমি দখলে নিয়েছেন গোলাম দস্তগীর গাজী এবং তাঁর ছেলে পাপ্পা। শুধু জমি দখলই নয়, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রকও গাজী সিন্ডিকেট। অস্ত্রবাজি, খুন, জমি দখল, চাঁদাবাজি, অবৈধ বালু উত্তোলন ও বিক্রি এবং মাদক সিন্ডিকেট চালানোয় গোলাম দস্তগীর গাজীর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছেন তাঁর ছেলে পাপ্পা ও তাঁর এপিএস এমদাদ। ওই সব অবৈধ কাজের মাধ্যমে মন্ত্রী সিন্ডিকেটের প্রত্যেকে শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।

সূত্র: কালেরকন্ঠ

সর্বশেষ