ভ্যাট-ট্যাক্স বৃদ্ধিতে ১০ সংকটের আশঙ্কা বিএনপির
সম্প্রতি অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও মূল্যস্ফীতির মধ্যেই একশটিরও বেশি পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি, নতুন করে আরোপ এবং কিছু পণ্যের কর অব্যাহতি তুলে নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এতে করে ১০টি সংকটের আশঙ্কা করছে বিএনপি।

ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর ইস্যু নিয়ে শনিবার রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দলটির নেতারা ১০টি সংকটের কথা তুলে ধরেন।  সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আওয়ামী লীগ তাদের দুর্নীতি, লুটপাটের কারণে কার্যত অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে।

১। বর্তমানে প্রায় ১৩ শতাংশ ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পাবে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির ফলে পরিবারের সঞ্চয় কমবে এবং ব্যাংক থেকে টাকা তোলার হার বেড়ে যাবে।

২। বর্তমানে নিম্নমুখী ৫.৮২ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরও কমবে। এর অর্থ হলো অর্থনীতির গতি স্থবির বা মন্থর হয়ে পড়েছে (ব্যবসা-বাণিজ্য) দ্রুত গতিতে না বাড়লে কারখানায় উৎপাদন না বাড়লে আয় বৃদ্ধি পাবে না। কর্মসংস্থান আরও কমে যাবে।

বেকারের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। এমনিতেই গত তিন বছর ধরে মানুষের প্রকৃত আয় কমছে। বিবিএস এর হিসেব অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরে মানুষের আয় বেড়েছে ৮ শতাংশ, কিন্তু জিনিসপত্রের দাম, অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি বেড়েছে প্রায় ১১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ১৪ আগস্ট আশ্বাস দিয়েছিলেন ৫/৬ মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সহনীয় হবে। কিন্তু বাস্তবে তা বরং বেড়েছে।
অথচ প্রতিবেশী দেশগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে তার সুফল পেয়েছে। বাংলাদেশ যথাসময়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেনি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রা ও রাজস্বনীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত পদক্ষেপের অভাব রয়েছে। গোষ্ঠীস্বার্থ উপেক্ষা করতে পারছে না সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বাড়াচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমাতে, অন্যদিকে, সরকার কর বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। এক মন্ত্রণালয় ডিম আমদানির অনুমতি দিচ্ছে, আরেক মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা তা আটকে দিচ্ছে। এই অদক্ষতা ও সমন্বয়হীনতার মাশুল দিতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে। একদিকে বিশ্বব্যাংক যেমন প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার কথা বলছে, তেমনই ২০২৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির ৫টি বড় ঝুঁকির কথা বলেছে, যেমন মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক বন্যা/তাপপ্রবাহ, দূষণ সুযোগের অভাব এবং অর্থনৈতিক নিম্নমুখিতা।৩। বিশ্বব্যাংকের ‘বৈশ্বিক বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক(এমপিআই) ২০২৪ অনুসারে’, বাংলাদেশের চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ১৭ লাখ। বর্তমানে আরোপিত নতুন করহার এই দরিদ্র মানুষদের দুর্ভোগ আরও বৃদ্ধি করবে। বিবিএস-এর তথ্য মোতাবেক, দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। সারাদেশে এ ধরনের কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬ কোটির মতো। এছাড়া ২০২২ সালের জানুয়ারির পর থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো মাসেই মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি মজুরি বৃদ্ধির হার। প্রতি মাসে গড়ে যত মজুরি বেড়েছে, মূল্যস্ফীতি ছিল তার চেয়ে বেশি। ফলে সাধারণ ও সীমিত আয়ের মানুষের বাজার থেকে নিত্যপণ্য ও সেবা কেনার সামর্থ্য কমেছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম -এর দেশব্যাপী গৃহস্থালি জরিপ ২০২৩ -এর অন্য সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, সেপ্টেম্বর ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ৭০ শতাংশ খানা বা পরিবার তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছে। ২০২৪ সাল শেষে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও, খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনো ১৩ ছুঁই ছুঁই! অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি চূড়ান্ত প্রতিবেদনের প্রদত্ত তথ্য মোতাবেক বর্তমানে প্রায় ২ কোটি লোক রয়েছেন যারা দুদিন কাজ বা আয় করতে না পারলে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে বাধ্য হবেন। পরিণতিতে জাতীয় দরিদ্রের হার পুনরায় ৪০ শতাংশে পৌঁছানোর আশঙ্কা করছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। সামগ্রিক অর্থনৈতিক চিত্র বিবেচনায় এটা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায়, নতুন করে ভ্যাট আরোপে স্বল্প আয়ের মানুষের দুর্দশা চরমভাবে বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

৪। বর্তমান উচ্চ মূল্যের জ্বালানি খরচ আরও বাড়বে।

৫। পর্যাপ্ত সময় না দিয়ে বিদ্যমান টার্নওভার ট্যাক্স থ্রেশহোল্ড ৫০ লাখ থেকে ৩০ লাখ এবং ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন থ্রেশহোল্ড ৩ কোটি থেকে ৫০ লাখে নির্ধারণ করা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ওপর কমপ্লায়েন্স প্রেসার বাড়াবে এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি বৃদ্ধি পাবে, যা দেশের জন্য কোনো অবস্থাতেই মঙ্গলজনক হবে না।

৬। ব্যবসায়িক ব্যয় (কস্ট অব বিজনেস) এবং শিল্পকারখানাগুলোতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাবে এবং মোট উৎপাদন হ্রাস পাবে। এতে বেকারত্ব আরও বৃদ্ধি পাবে। এমনিতেই বিভিন্ন পরিসংখ্যান মতে, দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৬০ হাজার। যদিও বেকারের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি।

৭। ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা আরও হ্রাস পাবে।

৮। নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীর জীবনধারণ আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।
৯। ব্যবসায় বিনিয়োগ কমবে।

১০। রপ্তানি প্রতিযোগিতার ক্ষমতা হ্রাস পাবে। সর্বোপরি, অর্থনীতি ও দেশের জনগণের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে 

সরকার নীতি সুদহার বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে, কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে শুধু নীতি সুদহার বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। একদিকে, নীতি সুদহার বাড়ানো ও অন্যদিকে, ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। বলা বাহুল্য, এতে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমবে, অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে।

সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জাবিউল্লাহ।

সূত্র: কালেরকন্ঠ

সর্বশেষ