ভ্যাট-ট্যাক্সে দুর্বিষহ জীবন
ভালো নেই সাধারণ মানুষ। গলদঘর্ম খেটেও পরিবারের সব চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। খরচের ফর্দ কাটছাঁট করেও কুলাতে পারছে না অনেকে। মূল্যস্ফীতির চাপে জীবনযাপন নিয়ে যখন তাদের হাঁসফাঁস অবস্থা, তখনই নতুন করে ভ্যাট-ট্যাক্সের খড়্গ।

আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ব্যবধান যখন বেড়েই চলছে, তখন এই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী বলে এরই মধ্যে বলা শুরু হয়েছে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে। চাল-ডাল থেকে শুরু করে মাছ, মাংস—সব কিছুতেই দাম বাড়ানোর যে প্রতিযোগিতা, তাতে সাধারণ মানুষের খেয়ে-পরে টিকে থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।এমন সংকটের মধ্যেই নতুন করে শতাধিক পণ্য ও সেবায় সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্সের জেরে জীবনযাত্রার ব্যয় আরেক দফা বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলছেন, সরকারের পদক্ষেপ দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়াবে।

এতে সংকট তৈরি হবে ব্যবসায় এবং চাপে পড়বে দেশের সার্বিক অর্থনীতি। তাঁরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যবসায়-বিনিয়োগ নেতিবাচক ধারার চলছে, তা আরো জটিল করে তুলবে। ব্যবসায় পরিস্থিতি আরো সংকটে পড়বে জানিয়ে দেশের রেস্তোরাঁ মালিকরা ভ্যাট প্রত্যাহারের আলটিমেটাম দিয়ে রেখেছেন। তা বাতিল করা না হলে অনির্দিষ্টকালের জন্য রেস্তোরাঁ বন্ধ রাখারও হুমকি দিয়ে রেখেছেন তাঁরা।
রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠনগুলো সোচ্চার হয়েছে। তাদের দাবি, এই অসময়ে ভ্যাট-ট্যাক্সের বাড়তি চাপ মানুষের পক্ষে সামলানো কঠিন হবে।নতুন করে ভ্যাট-ট্যাক্সের কোপ

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত পূরণে রাজস্ব বাড়াতে ইন্টারনেটসহ ৬৭ পণ্য ও সেবার ভ্যাট-সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে গত বৃহস্পতিবার অধ্যাদেশ জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতে এসব পণ্য ও সেবার দাম বাড়তে পারে।

এই তালিকায় রয়েছে ওষুধ, এলপি গ্যাস, মিষ্টি, বিস্কুট, আচার, টমেটো সস, ফলের রস, সিগারেট, সাবান ও ডিটারজেন্ট, মোবাইল সেবা ও ব্রন্ডব্যান্ড ইন্টারনেট।

এ ছাড়া টার্নওভারের তালিকাভুক্তি ও ভ্যাট নিবন্ধনের সীমা কমানো হয়েছে। এতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়প্রতিষ্ঠানকেও ভ্যাটের বিধি-বিধান পরিপালন করতে হবে, যা ব্যবসায়ের পরিচালন খরচ বাড়াতে পারে।এ ছাড়া যেসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে সেগুলো হচ্ছে কিচেন টাওয়েল, টয়লেট টিস্যু, সানগ্লাস, চশমার ফ্রেম, মিষ্টি, ম্যাট্রেস, ট্রান্সফরমার, এলপি গ্যাস, ফেরো ম্যাঙ্গানিজ (রড তৈরির কাঁচামাল), টমেটো সস, আচার-চাটনি, কেক, বিস্কুট, রং, ফলের রস, ফ্রুট ডিংকস, সাবান, ডিটারজেন্ট, বার্নিশ এবং সব ধরনের তাজা ফল।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘তিন বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে। মূল্যস্ফীতি শুধু একটি সংখ্যা নয়। যে মানুষগুলোর আয়ের ও ব্যয়ের ওপর কশাঘাত আসছে, তারা এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় সরকারের ট্যাক্স-ভ্যাট বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া ঠিক হয়নি। ভ্যাট-সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর তালিকায় এমন অনেক পণ্য-সেবা আছে, সেখানে সাধারণ মানুষের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। শুধু গরিব মানুষই পড়বে না, মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষের ওপরও চাপে পড়বে। এটা সাধারণ মানুষকে চাপের মধ্যে ফেলবে এবং তাদের অসহিষ্ণুতাও বাড়াবে।’

এই উদ্যোগকে আইএমএফের যে শর্ত আছে, সেই শর্তের চাপের কাছে নতি স্বীকার বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে কর ফাঁকির পরিমাণ অনেক বেশি, সামর্থ্যবান মানুষের অনেকেই সঠিকভাবে কর দেন না। প্রত্যক্ষ করের মধ্যে অনেক ধরনের ছাড় রয়েছে, সেগুলোকে হয়তো যৌক্তিক করা যেত। কর ফাঁকি রোধ করা সরকারের ১ নম্বর অগ্রাধিকার হওয়া উচিত ছিল। এর পরই অগ্রাধিকারে থাকা উচিত প্রত্যক্ষ করহারের যৌক্তিকীকরণ।’

জীবনযাত্রার ব্যয় লাগামহীন, বাড়ছে না আয়

রাজধানীতে জীবনযাত্রার ব্যয় ১১.০৮ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনটির সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রায় ১৭ পণ্য জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিতে সরাসরি ভূমিকা রেখেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় শহুরে নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্যতালিকা ও জীবনযাত্রায় মাছ-মাংসের চাহিদা কমে গেছে। ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছিল ৬.৯২ শতাংশ। ক্যাব বলছে, বিদায়ি বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির পরিমাণ দুই অঙ্ক ছাড়াবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালে রাজধানীতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬.৮৮ শতাংশ, যা ২০১৯ সালে ৬.৫০ শতাংশ ছিল।

ক্যাবের সিনিয়র সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘নিম্ন আয়ের মানুষ অনেক কষ্টে আছে। অনেকে কম খেয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। আবার কেউ কেউ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। যেসব পণ্যে শুল্ক কমানো হয়েছে তার কোনো প্রভাব পড়ছে না ক্রেতা পর্যায়ে। এর মধ্যে নতুন করে শুল্ক-কর বাড়ানোর ফলে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরেক দফা বাড়বে। এই ব্যয় অন্তত ১৫ শতাংশ বাড়তে পারে। ভোক্তারা সংগঠিত নয়, তারা কষ্টের কথা বলতে পারছে না। সরকার আমাদের সঙ্গে বসছে না। চলমান সংস্কার কার্যক্রমে ভোক্তাস্বার্থ উপেক্ষিত থেকে যাবে আমার বিশ্বাস।’

বাড়তি মূল্যস্ফীতি, কষ্টে মধ্যবিত্ত

দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো না থাকায় মূল্যস্ফীতি এখনো বাড়তির দিকেই আছে; বিশেষ করে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেশি। এ কারণে মধ্যবিত্ত মানুষ কষ্টে আছে। নিম্নবিত্তদের ওপর চাপ বাড়ছে। গত বুধবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা শিকার করেছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।

তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির কারণে মধ্যবিত্তরা কষ্টে আছে, নিম্নবিত্ত, শ্রমজীবী ও দিনমজুরদের ওপর চাপ বাড়ছে। সবাই বলছে, মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। যেটুকু কমেছে, এটিকে কিন্তু কম বলা যায় না। মূল্যস্ফীতি এখনো বাড়তিই আছে।’

সম্প্রতি অর্থনৈতিক বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, বাস্তবে মূল্যস্ফীতির হার ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ। যদিও পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.৩৪ শতাংশ। তার আগের বছর ২০২৩ সালে এই হার ছিল ৯.৪৮। গত বছর উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ছিল মানুষ। সে তুলনায় মানুষের আয় বাড়েনি।

ডিসেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২.৯২ শতাংশ। আর সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ১০.৮৯ শতাংশ। তবে মূল্যস্ফীতির এ দুই হার এখনো দুই অঙ্কের ঘরে থাকার মানে হলো, নির্দিষ্ট আয়ের মানুষকে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

জাতীয় মজুরি হার কয়েক মাস ধরেই ৮ শতাংশের ঘরে আটকে আছে। মূল্যস্ফীতির তুলনায় মানুষের আয় কম হারে বাড়ায় মানুষের কষ্ট বাড়ছে।

এদিকে মূল্যস্ফীতির হার বেশি মাত্রায় বাড়লেও মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল একেবারেই কম। চলতি বছরের ১১ মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি গড়ে ১.৫২ এবং খাদ্যে ৪.২৪ শতাংশ বেড়েছে। এর বিপরীতে মজুরি বেড়েছে মাত্র ০.৩৩ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি বেশি ও মজুরি কম বাড়ায় ভোক্তাকে জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে হয়েছে। এতেও পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে ঋণ করতে হয়েছে। যে কারণে সঞ্চয় কমেছে।

ক্ষমতায় নতুন সরকার আসার পর সুদের হার বাড়িয়ে কিছু শুল্ক কমানোসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নিলেও মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরা যায়নি। পরে টাকা ছাপিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে। নতুন বছরেও টাকা ছাপানো অব্যাহত থাকলে মূল্যস্ফীতি আরো অসহনীয় হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, ‌‘সরকারের রাজস্ব আহরণ যেহেতু কম হয়েছে, তাই তাদের আর কোনো বিকল্প ছিল না। রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর জন্য এটা করা হয়েছে। কিন্তু এটা সরকারের মূল্যস্ফীতি কমানোর যে উদ্দেশ্য, সেটার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। রাজস্ব আহরণের যুক্তিতে তারা যেটা করেছে, সেটা কতোখানি কাজে দেবে তা এখনো বলার সময় আসেনি। এটা সময়ই বলে দেবে। অন্তর্বর্তী সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর উদ্যোগ মূল্যস্ফীতি কমানোর ক্ষেত্রে একটা বাধা হিসেবে কাজ করবে।’

যা করণীয়

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শতাধিক পণ্যে শুল্ক ও করহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এবং শিল্পে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগ অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী বলেছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ। দেশের অর্থনৈতিক চাপ মোকাবেলায় সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দেশের জিডিপিতে করের অবদান বেশ কম। এমন পরিস্থিতিতে বিদ্যমান অর্থনৈতিক চাপ মোকাবেলায় সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের কোনো বিকল্প নেই। সরকারি ব্যয় ২০ শতাংশ কমানো হলে বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।’

ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, অর্থনৈতিক চাপ মোকাবেলায় সরকারি ব্যয়ে যেমন কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে, একই সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়া যাবে না। এ ছাড়া এডিপি বাস্তবায়নে স্বচ্ছতার পাশাপাশি সময়মতো প্রকল্প শেষ করার বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে।

এদিকে ক্যাব বলেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোকে পর্যাপ্তভাবে কাভার করার জন্য যথাযথ পরিবীক্ষণের সঙ্গে ওএমএস কার্যক্রম শক্তিশালী করা উচিত। দেশে এক কোটি পরিবারকে খাদ্য সহায়তা বৃদ্ধি করা উচিত। দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির আওতাও বাড়াতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা জোরদার করার মাধ্যমে শহুরে নিম্ন আয়ের মানুষের প্রতি আরো বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত। এ ছাড়া শহুরে নিম্নমধ্যম ও মধ্যম আয়ের পরিবারের জন্য বিশেষ সামাজিক সুরক্ষা স্কিম তৈরি করা উচিত, যাতে তারা সফলভাবে মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়।

ক্যাবের সিনিয়র সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পর্যবেক্ষণ বাড়ানো উচিত। সিন্ডিকেট ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ক্যাব ও গণমাধ্যমকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।’

সর্বশেষ