বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হলো আরো ৫ ব্যাংকের এমডিকে

সবকিছুর দাম একসঙ্গে বাড়ানোর প্রভাব: ভ্যাট আরোপ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার দাবি * খেলাপি ঋণের নতুন সংজ্ঞা বাস্তবায়ন এক বছর পিছিয়ে দিতে হবে

ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, একসঙ্গে ব্যাংক ঋণের সুদের হার, ডলারের দাম, ভ্যাট ও ট্যাক্স, গ্যাসের দাম এবং কর্মীদের বেতন বাড়ানোয় খরচ বেড়েছে। এলসি খুলতে সমস্যা, ঋণের জোগান কম এবং বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি ও পণ্যের দাম বাড়ায় ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। ফলে পণ্যের বিক্রি কমেছে। নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। এসব কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।

রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে বৈঠকে ব্যবসায়ী নেতারা এসব কথা বলেন। বৈঠকে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী (পারভেজ)-সহ বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ব্যবসায়ীরা গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার, বাড়তি ভ্যাট আরোপ করা থেকে বিরত থাকা এবং খেলাপি ঋণের আন্তর্জাতিক মানের সংজ্ঞার বাস্তবায়ন এক বছর পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তাদের আরও দাবি-ঋণের কিস্তি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে ঋণের জোগান বাড়ানো এবং নতুন করে এক্সিট পলিসি দেওয়া হোক।

তারা বলেছেন, ইতোমধ্যে বহুবিধ সংকটে পড়ে দেশের বড় ও মাঝারি শিল্পগুলো সংকটে পড়ে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে এসব শিল্প রুগ্ণ হয়ে পড়বে। তাই ব্যবসা-বাণিজ্য বাঁচাতে এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জোর দাবি জানান তারা। বৈঠক শেষে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ সাংবাদিকদের বলেন, সরকার একসঙ্গে অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেগুলোর কারণে শিল্পের খরচ বেড়েছে। অন্যদিকে ভোক্তার আয় কমায় বিক্রি কমে গেছে। ফলে ব্যবসায়ীদের হাতে নগদ টাকার প্রবাহ কমে গেছে। এ অবস্থায় উদ্যোক্তারা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারছেন না। এজন্য এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এক্সিট পলিসি চাওয়া হয়েছে।

বৈঠকে আরও উপস্থিতি ছিলেন বিসিআই-এর পরিচালক ও প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহসান খান চৌধুরী, বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) প্রশাসক মো. আনোয়ার হোসেন, এলএফএমইবির সিনিয়র সহসভাপতি নজরুল হাসান সোহেল, রাভিডার সভাপতি আব্দুল হক, বিজিএমইএ-এর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মইনুল ইসলাম স্বপন, সিটি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হাসান, কোকা-কোলা বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদাপ আহমেদ, বিসিআই-এর সিনিয়র সহসভাপতি প্রীতি চক্রবর্তী, সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা অমিতাভ চক্রবর্তী প্রমুখ।

বৈঠকে ব্যবসায়ীরা গভর্নরকে বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নতুন বিনিয়োগ তো দূরের কথা, চলমান ব্যবসা টিকিয়ে রাখতেই হিমশিম খাচ্ছি। তাই ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে এক্সিট পলিসি বা বের হওয়ার নীতিমালা চাওয়া হয়েছে।

বৈঠকে বলা হয়, সরকার ঋণের উচ্চ সুদহার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের দাম বৃদ্ধি, ভ্যাটের হার বাড়ানো-সবকিছু একসঙ্গে করেছে। এদিকে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা যাচ্ছে না। শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতেও এলসি খোলায় সমস্যা হচ্ছে। এতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে পণ্যের দামও বাড়াতে হয়েছে। দেশে বর্তমানে উচ্চ মূদ্রাস্ফীতির কারণে ভোক্তার আয় কমে গেছে। বিনিয়োগ কম হওয়ায় কর্মসংস্থান বাড়ছে না। ফলে আয় বাড়ছে না ভোক্তার। এতে সব প্রতিষ্ঠানের পণ্য বিক্রি কমে গেছে। বিক্রি কমায় উদ্যোক্তাদের হাতে টাকার প্রবাহও কমে গেছে। ফলে উদ্যোক্তারা আগের ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। এতে খেলাপি হচ্ছে। খেলাপি হওয়ার কারণে নতুন ঋণ পাচ্ছে না। ফলে ব্যবসা বন্ধের উপক্রম হচ্ছে।

এসব মিলিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান তার পূর্ণ সক্ষমতায় চলতে পারছে না। উৎপাদন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে গেছে। চলতি অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি দেড় শতাংশে নেমেছে। নতুন গ্যাস সংযোগে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা হচ্ছে। আবার আইএমএফ-এর সুপারিশে বিভিন্ন পণ্যের ওপর কর/মূসক বৃদ্ধি করা হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকাই এখন চ্যালেঞ্জ। বর্তমান পরিস্থিতিতে শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হবে। আর শিল্প টিকে থাকলে বৈদেশিক মুদ্রার কোনো সমস্যা হবে না। এজন্য শিল্প খাতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুতের জোগান বাড়াতে হবে। গ্যাসের দাম এখন বাড়ানো যাবে না। বড় শিল্পে ঋণের জোগান বাড়াতে বড় অঙ্কের ঋণসীমা শিথিল করতে হবে। ব্যাংক তারল্য সংকটে থাকার কারণে ঋণের জোগান মিলছে না। ব্যাংকে তারল্য প্রবাহ বাড়িয়ে ঋণের জোগান বাড়াতে হবে। বৈঠকে তারা আরও বলেন, এখন থেকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা কার্র্যকর করা হলে বেশির ভাগ উদ্যোক্তাই খেলাপি হয়ে পড়বেন। এ কারণে এ সংজ্ঞার বাস্তবায়ন আরও এক বছর পিছিয়ে দেওয়ার দাবি করেন তারা।

বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবসায়ীদের বক্তব্যগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনেছে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সেটির বিষয়ে খতিয়ে দেখার কথা বলেছে।

বৈঠকে দেশের রপ্তানিমুখী শিল্পের নগদ সহায়তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, নগদ সহায়তার টাকা পেতে ৯ মাস থেকে ১ বছর সময় লাগছে। ফলে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো সময়মতো তাদের অপারেশন কস্ট মেটানো বা তাদের কর্মীদের বেতনাদি পরিশোধ করতে পারছে না। নগদ সহায়তা প্রদানের সময়সীমা ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছেন তারা।

বর্তমানে কোনো শিল্প গ্রুপ ব্যাংকের মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ ঋণ নিতে পারে। এ সীমা বাড়িয়ে ৩৫ শতাংশ করার দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, খেলাপি ঋণ বাড়ায় ব্যাংকের মূলধন কমে গেছে। ফলে বড় অঙ্কের ঋণসীমাও কমেছে। এ কারণেই মূলত ঋণসীমা বাড়ানোর দাবি জানান।

সর্বশেষ